অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মাছের আঁশ রপ্তানি করে বছরে অন্তত ১শ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেশীয় বিভিন্ন কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের পর প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আঁশ রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। তবে করোনাকালে সংকট চলছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অপ্রচলিত পণ্যের এই খাত রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বাড়ছে। বছরে এই ধরনের প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হয়। এই ধরনের একটি পণ্য হচ্ছে মাছের আঁশ। এখন কোটি কোটি টাকার আঁশ রপ্তানি হচ্ছে। ফেলে দেওয়া এই বর্জ্য সংরক্ষণ করে বাংলাদেশ মাছের আঁশের বড় বাজারের অংশীদার হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, রপ্তানি ছাড়াও মাছের আঁশের বড় বাজার গড়ে উঠেছে দেশে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক মানুষ আঁশ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। লাখ লাখ টাকার ব্যবসাও করছেন। প্রান্তিক পর্যায়ে মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা আয় করছেন এমন মানুষের সংখ্যাও অনেক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঘরে ঘরে মাছের যে আঁশ পাওয়া যায় তা এখনো বাজারের বাইরে রয়ে গেছে। তবে মাছ বাজার এবং হোটেল রেস্তোরাঁ, কমিউনিটি সেন্টারকে এই প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ মাছের আঁশের ওপর নির্ভরশীল। গড়ে উঠেছে প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাও। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর পদস্থ একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে বলেন, মাছের আঁশ থেকে নানা ধরনের পণ্য তৈরি হচ্ছে। দেশে মাছের আঁশ গুঁড়ো করে মুরগির ও মাছের খাবার তৈরি করা হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্যাপসুলের কাভার তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে আঁশ। লিপস্টিক, নেইল পালিশসহ বিভিন্ন ধরনের প্রসাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির কাঁচামাল, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, বোতাম, চিরুনি ও কুটির শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে এই আঁশ। উপরোক্ত পণ্যগুলো উৎপাদনে দেশীয় বিভিন্ন কারখানা মাছের আঁশ ব্যবহার করছে। তেমনি প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আঁশ রপ্তানিও হচ্ছে। জাপান, চীন, হংকং ও ভিয়েতনামসহ বিশ্বের নানা দেশে মাছের আঁশ যাচ্ছে। চট্টগ্রামে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনেকেই এই ব্যবসার সাথে জড়িত। তবে ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে তিনটি কারখানা থেকে নিয়মিত মাছের আঁশ রপ্তানি হয়। অবশ্য করোনাকালে এই খাতে সংকট তৈরি হয়েছে।
জানা যায়, মাছের আঁশ সংগ্রহ হয় মাছের বাজার থেকে। বাজারে মাছ কাটার জন্য যারা থাকেন তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় আঁশ। আঁশের সাথে কানকো, লেজের অংশ, নাড়িভুড়িসহ কিছু বর্জ্য থাকে। এদের কাছ থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা আঁশ সংগ্রহ করেন। তারা আঁশ নিয়ে গিয়ে বাছাই করেন। শুধু আঁশ রেখে বাকি বর্জ্য ফেলে দেন। হালকা গরম পানিতে ধুয়ে দুদিন রোদে শুকালে মচমচে হয়ে যায়। পরবর্তীতে গুঁড়ো করে মুরগি ও মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রামসহ সারা দেশে মুরগি ও মাছের খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মাছের আঁশ কিনে।
প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আঁশ সংগ্রহ করা হয় কারখানাগুলোতে। তাদের কাছ থেকে রপ্তানিকারকেরাও সংগ্রহ করেন। রোদে শুকানো আঁশ ২৫ কেজি করে প্যাকেট করা হয়। ওই প্যাকেট বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
জাপান আঁশের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হিসেবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যবসা করছে বলে জানান রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মাছের আঁশ রপ্তানির সাথে জড়িতরা বাজার সম্প্রসারণে নানাভাবে চেষ্টা করলেও করোনার কারণে সংকটে পড়েছেন। এখন আঁশ রপ্তানির পরিমাণ কমে গেছে। এক বছর আগে যে প্রতিষ্ঠান দেড় লাখ ডলারের আঁশ রপ্তানি করেছে, ওই প্রতিষ্ঠান গত দশ মাসে ২০ হাজার ডলারের আঁশও রপ্তানি করতে পারেনি। এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা দরকার।
তিনি বলেন, এরা দেশের জন্য বড় কিছু করছে। বর্জ্য ব্যবহার করে সোনা ফলাচ্ছে। এক টাকাও পাওয়া যেত না এমন একটি খাতে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। মানুষের কর্মসংস্থান করছে। এদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে সমাজ উপকৃত হবে।
নগরীর কাজির দেউড়ি বাজারে মাছ কাটার সাথে জড়িত একজন শ্রমিক আজাদীকে বলেন, মাছ কাটার পর আঁশগুলো জড়ো করে রাখি। রাতে এক ব্যক্তি এসে এগুলো নিয়ে যান। পুরো বছরের মাছের আঁশ তিনিই নেন। বছরে আমাদের ৯০ হাজার টাকা দেন।
বিভিন্ন বাজার থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে ফিশারিঘাট এলাকায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে রোদে শুকান মানিক। তিনি আজাদীকে বলেন, বাজার থেকে সংগ্রহ করে ধুয়ে রোদে শুকাই। পরে পার্টির কাছে বিক্রি করি। আগে প্রতি কেজি ১২০-১৩০ টাকা দরে বিক্রি হতো। করোনার কারণে তা কমে ৩৫-৪০ টাকায় চলে এসেছে। তিনি জানান, আগে মাসিক ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় হতো। এখন ২০-৩০ হাজার টাকা আয় হয়। করোনা চলে গেলে দাম আবার বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
খুলনার মা এঙপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি মাছের আঁশের বড় রপ্তানিকারক। করোনার কারণে এখন রপ্তানি কার্যক্রম সীমিত উল্লেখ করে মোহাম্মদ ইমরুল আলম নামে এই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান সারা দেশ থেকে মাছের আঁশ সংগ্রহ করে। বিদেশ থেকেও ক্রেতারা আসেন। বিভিন্ন দেশে আঁশের বড় বাজার রয়েছে জানিয়েছে তিনি বলেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অপ্রচলিত পণ্যের এই খাতে রপ্তানি আরো বাড়বে।
মন্তব্য করুন